জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেষ্ঠ্যপুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ কামাল ছিলেন বাঙালির ক্ষণজন্মা সব্যসাচী কীর্তিমান পুরুষ, ক্রীড়া-সঙ্গীত-মঞ্চ নাটকে সমান পারদর্শী ছিলেন, তাছাড়া রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি ছিলেন বাঙালি তরুণ প্রজন্মের পথপ্রদর্শক। সরলমনা শেখ কামাল ছিলেন বন্ধুবৎসল, সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের সঙ্গেও ছিলো তাঁর যোগাযোগ, তাঁর ভাবনায় ছিলো অবহেলিত মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও বাঙালির সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধনের কথা।
শেখ কামাল উপ-মহাদেশের অন্যতম ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক পরিচিতি পান, তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’, ফুটবল ও ক্রিকেটের প্রতি দুর্বল ছিলেন শেখ কামাল। দারুণ ক্রিকেট খেলতেন তিনি; তবে ফুটবলের সংগঠক হিসেবে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা থেকেই শেখ কামাল তাঁর জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন তৎকালীন বাংলাদেশের সেরা অ্যাথলেট সুলতানা কামালকে।
শেখ কামাল ১৯৭৫ সালের ক্রিকেট লীগের চ্যাম্পিয়ন আবাহনী ক্লাবের নিয়মিত উদ্বোধনী বোলার ছিলেন। তিনি ১৯৭৫ সালে বাস্কেটবল লীগ চ্যাম্পিয়ন আজাদ বয়েজ ক্লাবে নিয়মিত খেলেছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের হয়ে খেলেছেন। শেখ কামাল ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার দ্রুততম মানব। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় ব্যাডমিন্টনের দ্বৈত রানার্স-আপ হয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন শেখ কামাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তঃহল ফুটবলেও নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। শেখ কামাল তৎকালীন ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন। খেলাধুলার বাইরেও শেখ কামাল নিয়মিত মঞ্চ নাটক করতেন, গান গাইতেন; দারুণ সেতার বাজাতেন। শেখ কামাল ছিলেন অনন্য-সাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তিনি খুব সহজেই সাধারণের সঙ্গে মিশে যেতেন, জাতির পিতার সন্তান হিসেবে কোনো অহংকার তাঁর ছিলো না।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নের জন্য শেখ কামাল ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর বরেণ্য ক্রীড়া সংগঠকদের দ্বারে-দ্বারে। তিনি চেয়েছিলেন ফুটবল এবং ক্রিকেটের আলাদা আলাদা পূর্ণাঙ্গ ইন্সটিটিউট করার, বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনিÑযারা পুরো পৃথিবীময় ব্র্যান্ডিং করবে বাংলাদেশকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে যেখানে আমাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য ভাবতে হচ্ছে জাতির পিতাকে, সেই সময়ে সারাবিশ্বে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার জন্য শেখ কামাল নেমে পড়েন নতুন এক যুদ্ধে, সেই যুদ্ধ বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে যুদ্ধ, সেই যুদ্ধ বাংলাদেশের ফুটবলকে নিয়ে যুদ্ধ, সেই যুদ্ধ বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নিয়ে যুদ্ধ; নতুনভাবে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুন পরিচয়ে অঙ্কিত করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা ক্রমাগতভাবে শেখ কামালের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছড়াতে থাকে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব রটিয়ে দীর্ঘদিন মানুষের মন থেকে তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, বিশেষ করে শেখ কামালকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় প্রতিনিয়ত; তবে শেখ কামালের বিরুদ্ধে সকল গুজবই আজ কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে।
শেখ কামালের জন্ম হয়েছিলো গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের খুব সাধারণ এক পরিবারে ১৯৪৯ সালের আগস্টের পাঁচ তারিখে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। খুব ছোট বেলা থেকেই ডানপিটে শেখ কামাল পিতার আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলো। সত্যি বলতে কি, শেখ কামাল জন্মের পর থেকেই তাঁর পিতার সাথে তাঁর ভালোমতো দেখাই হয়নি। কারণ তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠছেন, বাঙালি জাতির মুক্তিদূত হয়ে উঠছেন। পাকিস্তানি শোষকদের নির্মম শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলবার কারণে, প্রতিবাদ করবার কারণে তাঁর পিতাকে প্রায়ই কারাবরণ করতে হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ শিরোনামের স্মৃতিকথার এক জায়গায় ছোট ভাই শেখ কামাল সম্পর্কে লিখেছেন, “কামাল তখন অল্প কথা বলতে শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনো দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা আব্বা বলে ডাকছি, ও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানায় একটা বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খোলা মাঠ। ওই মাঠে আমরা দুই ভাইবোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম। অনেক ফুল, পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলÑ‘হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?’ কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে, আমি তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না।”
শেখ কামাল সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা লিখেছেন, “আমাদের সময়ে জামা-কাপড়ের সংখ্যা তো কারোই বেশি ছিল না। কামাল ভাই, জামাল ভাই কারোই না। কামাল ভাই খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। খুব গুছিয়ে রাখতেন সবকিছু। কিন্তু বেশি কিছুই চাইতেন না। আমার কাছে এসে হয়তো কোনদিন বলতেন, ‘দশটা টাকা দিবি?’ তিনি বিড়ি-সিগারেট কোনদিন খাননি। খরচ তো কিছুই ছিল না। কত যে তাঁর গুণ ছিল। আমি তো বলি, আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি তাদের মামার একটা গুণও পায়, সেও হবে অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। কামাল ভাই সেতার বাজাতেন। ধরা যাক, বাড়িতে অনেক মানুষ। আমার পরীক্ষা। পড়ব কোথায়? পড়ার জায়গার খোঁজে ছাদে গেছি। গিয়ে দেখি কামাল ভাই। হাতে সেতার। আকাশে চাঁদ। চারদিক থই থই করছে জোছনায়। কামাল ভাই বললেন, ‘পড়তে হবে না আজকে। অত পড়ে কি করবি? আয় আমার সঙ্গে বস। গান ধর।’ আমি তাঁর সঙ্গে গান ধরলাম। একজন-দু’জন করে এসে সবাই বসে পড়ল পাশে। জামাল ভাই এলেন। হাসু আপা এলেন। আমরা গান করছি। আকাশে তখন চাঁদ, নারকেলের পাতার ফাঁকে অকৃপণ আলো বিলাচ্ছে কোনায় কোনায়। হাসু আপার কোলে রাসেল, তার ঢুলু ঢুলু চোখে এসে পড়েছে চাঁদের আলো। হাস্নাহেনার গন্ধ বয়ে আনছে রাতের বাতাস।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল ঢাকার শাহীন স্কুলে থাকাকালীন ছিলেন স্কুলের প্রতিটি খেলার অপরিহার্য অংশ। এরমধ্যে ক্রিকেটটা তাঁকে টানতো সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘদেহী ফাস্ট বোলার ছিলেন, নিখুঁত লাইন-লেন্থ আর প্রচণ্ড গতি দিয়ে খুব সহজেই টালমাটাল করে দিতেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে। অবিভক্ত পাকিস্তানের অন্যতম উদীয়মান পেসার ছিলেন, কিন্তু একমাত্র বাঙালি হবার কারণে এবং বঙ্গবন্ধুর পুত্র হবার অপরাধে জুয়েল, রকিবুলদের মত এই প্রতিভাও অবহেলিত, উপেক্ষিত হয়েছিলেন নিদারুণভাবে। আরেক ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ মুশতাকের তিল-তিল পরিশ্রম আর চেষ্টায় গড়া আজাদ বয়েজ ক্লাব তখন শেখ কামালের মত উঠতি প্রতিভাদের লালনকেন্দ্র। এখানেই শেখ কামাল প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন দীর্ঘদিন। শুধু খেলাধুলাই নয়, পড়াশোনা, সঙ্গীতচর্চা, অভিনয়, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা থেকে শুরু করে বাঙলা সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরবার চেষ্টা, কোথায় নেই শেখ কামাল!
ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ভর্তি হলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত হলো তাঁর কর্মপরিধি। ছায়ানটের সেতারবাদন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী শেখ কামাল, সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আর ম. হামিদের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ঢাকা থিয়েটার। সু-অভিনেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে সুপরিচিত ছিলেন তিনি। এদিকে খেলাধুলাও কিন্তু চলছে পুরোদমে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শেখ কামাল বাস্কেট বল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। বাস্কেটবলে তাঁর দক্ষতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিলো একমাত্র তাঁর ক্রীড়া কৌশলে। এর মাঝে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সামরিক সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করলো নিকৃষ্টতম ধর্মান্ধতার পরিচয় দিয়ে। কিন্তু শেখ কামালকে কি আর থামানো যায়!
বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতার সন্তান তিনি, নেতৃত্বগুন আর জাতীয়তাবোধের চেতনা তাঁর ধমনীতে জন্ম থেকেই বাই ডিফল্ট সেট-আপ করা। তাঁর প্রতিবাদের ভাষা হলো রবীন্দ্রসঙ্গীত, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে যেখানে যখনই সুযোগ পেলেন, তখনই বিশ্বকবির গান গেয়ে অসহিংস প্রতিবাদের অসাধারণ উদাহরণ রাখলেন তিনি। কিন্তু ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তানি শাসকেরা ছাড়িয়ে গেলো নিষ্ঠুরতার সকল সীমা। শেখ কামালের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানি কারাগারে, পুত্র শেখ কামাল বাঙলা মায়ের সম্ভ্রম রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধে। বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন শেখ কামাল। তাঁর মতো বাঙলা মায়ের এমন অসংখ্য বীর সন্তানের অভূতপুর্ব বীরত্বগাঁথায় নয় মাসের রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো নতুন এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ; বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশ পুনর্গঠনে নিজের অসামান্য মেধা আর অক্লান্ত কর্মক্ষমতা নিয়ে জাতির পিতার ডান বাহু হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শেখ কামাল। বন্ধু স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার তানভীর মাজহার তান্নার সাথে যুদ্ধের সময় প্রায়ই আলাপ হতো শেখ কামালের। বারবার আক্ষেপ আর আশাবাদের মিশেলে বলতেন শেখ কামাল, ‘তান্না, আমরা কি আর দেশে ফিরে যেতে পারবো না? দেখে নিস, দেশ স্বাধীন হলে খেলার ছবিটাই বদলে দেবো আমি।’
কথা রেখেছিলেন শেখ কামাল। স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরেই আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থা গড়ে ১৯৭২ সালে সেই সংস্থার নামে কেনা হলো ইকবাল স্পোর্টিং ফুটবল দল। ক্রিকেট আর হকির দল কেনা হলো ইস্পাহানী স্পোর্টিংয়েরটা। এগুলোর সমন্বয়ে নতুন যাত্রা শুরু হলো আবাহনী ক্রীড়াচক্র নামে একটা ক্লাবের। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি এই খেলাগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন শেখ কামাল। স্বপ্ন দেখতেন একদিন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে এক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। সেই লক্ষ্যে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন সবক্ষেত্রেই, উপমহাদেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে দিয়েছিলেন সব খেলার খোলনলচে। ক্র্যাক প্লাটুনের যোদ্ধা শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েলের মতো অসাধারণ সব প্রতিভাগুলো যেন আর হারিয়ে না যায়, সেই লক্ষ্যে ক্রিকেটকে ঢেলে সাজাবার মাস্টারপ্ল্যান করেছিলেন শেখ কামাল। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে তৈরি করছিলেন নতুন দিনের জন্য, আপাতত লক্ষ্য আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। স্বপ্ন কিন্তু এখানেই শেষ নয়, দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে সেটা বহুদূরে বিস্তৃত।
আর ফুটবলে তো রীতিমতো বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন শেখ কামাল। দূরদর্শিতা আর আধুনিকতার অপূর্ব সমন্বয়ে রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি করলেন তিনি গোটা উপমহাদেশে। সেই ১৯৭৩ সালে আবাহনীর জন্য বিদেশি কোচ বিল হার্টকে এনে স্রেফ দেশের ফুটবল প্রেমিকদেরই নয়, তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন এশিয়ার অন্যান্য ফুটবল পরাশক্তিকেও! তখন ক্লাব তো দুরের কথা, এই উপমহাদেশে জাতীয় দলের কোনো বিদেশি কোচ ছিলো না। ১৯৭৪ সালে আবাহনী যখন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ‘আইএফএ’ শিল্ড টুর্নামেন্ট খেলতে যায়, তখন আবাহনীর বিদেশি কোচ আর পশ্চিমা বেশভূষা দেখে সেখানকার কর্মকর্তা আর সমর্থকদের চোখ ‘ছানাবড়া’ হয়ে যায়! পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলা উপহার দিয়ে আবাহনী ক্রীড়াচক্র দর্শকের অবাক মুগ্ধতা অর্জন করেছিলো মাটি কামড়ে ছোট ছোট পাসে সাড়া মাঠজুড়ে চমৎকার ফুটবল দিয়ে। ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন কমল বসু’সহ আকাশবাণীর প্রথিতযশা ধারাভাষ্যকারবৃন্দ। শেখ কামালের হাত ধরেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিলো উপমহাদেশের ফুটবলে।
হকিতেও নতুন দিনের সূচনা করেছিলেন শেখ কামাল। যোগ্যতা, দক্ষতা আর মোস্ট ইম্পরট্যান্টলি দেশপ্রেমের অসামান্য স্ফূরণে শেখ কামাল বদলে দিচ্ছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্র।
শুধু ক্রীড়াই নয়, শিল্প-সাহিত্যের সব শাখা পুনর্গঠনে তিনি পালন করছিলেন অসামান্য অবদান। যারা এই দেশকে চায়নি, চায়নি স্বাধীনতা, এই উন্নতি, নতুন দিনের আগমন তাদের কেনো সহ্য হবে? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অপবাদ দেবার মতো দুঃসাহস কিংবা বুকের পাটা কখনই হয়নি অন্ধকারের ঘাতকচক্রের। তাই তারা বেছে নিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর সন্তানদের। যে শেখ কামাল ছিলেন মাটির মানুষ, কেউ কোনোদিন কোনো সাহায্যে তাঁর কাছে এসে বিফল মনোরথে ফিরে গেছে বলে তাঁর শত্রুরাও কোনোদিন বলতে পারবে না, সেই শেখ কামালের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র ফাঁদলো একের পর এক সাজানো মিথ্যা বানোয়াট গল্প। যে গল্পের নিখুঁত পরিবেশনায় কোনো ফাঁক ছিলো না, অকল্পনীয় নিরেট মিথ্যায় মোড়ানো যে গল্প দীর্ঘদিন মানুষকে গেলানো হয়েছিলো।
শেখ কামালের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের অন্যতম গুজব হচ্ছে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাত ছিলেন, বেশ তোলপাড় করে দেওয়া এক অভিযোগ। জাতির পিতার ছেলে হয়ে কীভাবে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে পারেন? তাঁর ব্যাংক ডাকাতি করবার কারণ কি? যে কারোর মনে প্রথমে এই দুটো প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক। এই ঘটনা ঘটবার সময় লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের তৎকালীন সাংবাদিক পিটার হেজেল হার্স্ট ছিলেন ঢাকায়। তাঁকে এই খবরটি গেলানোর চেষ্টা করলে (যাতে তিনি টেলিগ্রাফে খবরটি ছাপেন) তিনি বলেছিলেন, ‘একজন প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ব্যাংক ডাকাতির দরকার কী? টাকা চাইলে তো ব্যাংক ম্যানেজাররাই তাঁকে টাকা এনে দেবেন।’
পাকিস্তান-মার্কিন আর বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্মিলিত চক্রান্তে জিয়ার নির্দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতকের নির্মম ব্রাশফায়ারে সপরিবারে শহীদ হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল। তিনি হৃদয়ের সবটুকু উচ্ছ্বাস আর আবেগ জড়িয়ে ভালোবেসেছিলেন তাঁর স্ত্রী সুলতানাকে, হত্যাকাণ্ডের এক মাস পূর্বে বিয়ে হয়েছিলো শেখ কামাল আর সুলতানা কামালের। রূপকথার চেয়েও অসম্ভব সুন্দর তাঁদের ভালোবাসার পরিণয় স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র একমাস। সুলতানার হাতের মেহেদির রঙ শুকায়নি তখনো, টকটকে তাজা রক্তস্রোতে ডুবে গিয়েছিলো সব স্বপ্ন। চারিদিকে বিশ্বাসঘাতকদের ভিড়ে বাঙালির জীবনে একজন শেখ কামালকে খুব বেশি প্রয়োজন আজ।