কবিয়াল রমেশ শীল, কবিগানের
লোকায়ত ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক সমাজ সচেতনতার সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা
অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন মাইজভাণ্ডারী গানের কিংবদন্তি সাধক। জনপ্রিয় এই শিল্পী
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে এবং সেই সাথে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট
নির্বাচন পরবর্তী নূরুল আমিন বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
কবিয়াল রমেশ শীল ১৮৭৭
সালের ৯ মে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানার অন্তর্গত গোমদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন। তাঁর পিতার নাম চণ্ডীচরণ শীল। চণ্ডীচরণ শীল ছিলেন পেশাতে নাপিত ও গ্রাম্য কবিরাজ।
কবিয়াল রমেশ শীলের স্কুলজীবন ৪র্থ শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে পিতার মৃত্যুর সাথে সাথে
শেষ হয়ে যায়, পিতার মৃত্যুর পরে পরিবারের সকল দায়িত্ব এসে পড়ে কবির কাধে। তাঁর
নিজের লেখনীতে রয়েছে, ‘আমিই বালক, চালক, পালক, আমার আর কেহ নাই। মায়ের অলংকার সম্বল
আমার বিক্রি করে খাই’।
কবিয়াল রমেশ শীল পিতার
পেশায় কাজ শুরু করেন। অবশেষে তিনি ভাগ্যান্বেষণে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) রেঙ্গুন
শহরে গমন করেন। সেখানে একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে একটি দোকানেরও
মালিক হন। কিন্তু স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে পাঁচ বছরের মধ্যেই নিজের গ্রামে ফিরে
আসেন। গ্রামে এসে তিনি পূর্বের নরসুন্দর কাজের পাশাপাশি কবিরাজ (গ্রাম্য চিকিৎসক) হিসেবে
কাজ শুরু করেন। এই কবিরাজি করতে করতেই কবিগানের প্রতি তিনি ভীষণভাবে অনুরাগী হয়ে উঠেন।
কোনোরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা
ছাড়াই ১৮৯৭ সালে তিনি প্রথমবারের মতো মঞ্চে কবিগান পরিবেশন করেন এবং সমাদৃত হন। ১৮৯৯
সালে কবিগান পরিবেশনায় প্রতিদ্বন্দ্বী তিনজন কবিয়ালকে পরাজিত করলে উদ্যোক্তা ও শ্রোতাকূলের
কাছ থেকে মোট তের টাকা সন্মানী লাভ করেন, যা পেশা হিসেবে পরবর্তীকালে কবিগানকে বেছে
নিতে রমেশ শীলকে অনুপ্রাণিত করে।
১৯৩৮ সালে বাঙলা কবিগানের
ইতিহাসে প্রথম সমিতি গঠিত হয় রমেশ শীলের উদ্যোগে। কবিয়ালদের এই সমিতির নাম রাখা হয়
‘রমেশ উদ্বোধন কবি সংঘ’। অশ্লীলতা মুক্ত কবিগান ছিলো এই সমিতির অন্যতম লক্ষ্য। ১৯৪৪
সালে কবিয়াল রমেশ শীল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে
কবিকে সম্বর্ধিত ও ‘বঙ্গের শ্রেষ্ঠতম কবিয়াল’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক
নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। যে কারণে যুক্তফ্রন্ট
সরকার ভেঙে দেওয়ার পরে অন্যান্য নেতা-কর্মীর সাথে রমেশ শীলকেও গ্রেফতার করা হয়। তাঁর
‘ভোট রহস্য’ বইটি বাজেয়াপ্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার। কবি দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন ওই সময়ে।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরোধীতা করায় রমেশ শীলের সাহিত্য ভাতা বন্ধ
করে দেওয়া হয়। শেষ জীবনে কবিয়াল রমেশ শীল নিদারুণ অর্থ কষ্টের সম্মুখীন হন।
প্রথমদিকে প্রথাগত কবিয়ালদের
মতো রমেশ শীল পুরাণ ও কিংবদন্তি নির্ভর গান বাঁধতেন। তখন তাঁর গানের বিষয় ছিলো নারী-পুরুষ,
সত্য-মিথ্যা, গুরু-শিষ্য, সাধু-গেরস্থ ইত্যাদি কেন্দ্রিক। পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক
আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি প্রবলভাবে সমাজ সচেতন হয়ে ওঠেন। কবিগানের বিষয়বস্তুতে আসে
ব্যাপক পরিবর্তন। যুদ্ধ-শান্তি, চাষী-মজুদদার, মহাজন-খাতক, স্বৈরতন্ত্র-গণতন্ত্র, এসব
হয়ে যায় কবিগানের উপজীব্য।
১৮৯৮ সালে চট্টগ্রামের
ফিরিঙ্গিবাজারের মাঝিরঘাটে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে কবিগানের আয়োজন করা হয়। প্রায় হাজার
পঞ্চাশেক মানুষের উপস্থিতিতে কবিগান শুরু হয়। প্রধান কবিয়াল ছিলেন তৎকালীন সময়ের
জনপ্রিয় কবিয়াল মোহনবাঁশী ও চিন্তাহরণ। কিন্তু গানের আসরে চিন্তাহরণ অসুস্থ্য হয়ে
পড়েন। এতে শ্রোতারা হট্টগোল শুরু করে দেয়। তখন আয়োজকরা কবিয়াল দীনবন্ধু মিত্রকে
মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু কবিয়াল দীনবন্ধু মিত্র তাদের অনুরোধ গ্রহণ না
করে রমেশ শীলকে মঞ্চে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। প্রথমে ভয় পেলেও কোমরে চাঁদর পেঁচিয়ে
মঞ্চে উঠে যান রমেশ শীল। মাত্র একুশ বছর বয়সের রমেশ শীলকে প্রতিপক্ষের কবিয়াল মোহনবাঁশি
অবজ্ঞা করে বলেছিলেন, ‘এই পুঁচকের সাথে কি পালা করা যায়?’ প্রত্যুত্তরে রমেশ শীল বলেছিলেন,
‘উৎসব আর ভয় লজ্জা কম নয় / কে বা হারাতে পারে কারে / পুঁচকে ছেলে সত্যি মানি শিশু
ব্রজ ছিলো জ্ঞানী / চেনাজানা হোক না আসরে।’ ওই আসরে তিনি দর্শকদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে
বলেছিলেন, ‘মা আমার রাজকুমারী, চণ্ডীচরণ বাপ; আমি হইলে মানুষের বাচ্চা করবো না রে মাফ।’
জীবনের প্রথম আসরে তিনি টানা আট ঘণ্টা গেয়েছিলেন কবিগান। ওই আসরে কেউ কাউকে হারাতে
পারেনি। অবশেষে আয়োজকদের হস্তক্ষেপে কবিগান বন্ধ হয় সেদিনের মতো। তবে তখন থেকেই রমেশ
শীলের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে বাঙলাজুড়ে।
কবিগানের ভাষা ও পরিবেশনা
থেকে অশ্লীলতা বিসর্জনে কবি ছিলেন সদা সতেষ্ট। স্থুল অঙ্গভঙ্গি ও কুরুচিপূর্ণ শব্দযোগে
যৌনতার পরিবেশন ছিলো কবিগানের আসল আকর্ষণ। রমেশ শীলের শিল্পিত উপস্থাপন ও মার্জিত শব্দচয়ন
কবিগানে রুচিশীলতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। দেশাত্মবোধ, দুর্ভিক্ষ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন
তাঁর গানের ভাষায় উঠে এসেছে জোরালো ভাবে। যেমন, ‘ব্যবসার ছলে বণিক এলো / ডাকাত সেজে
লুট করিলো / মালকোঠার ধন হরে নিলো—আমারে সাজায়ে বোকা / কৃষক মজদুর একযোগেতে / হাত
মেলালে হাতে হাতে / শ্বেতাঙ্গ দুশমনের হতে—যাবে জীবন রাখা।’ অথবা, ‘দেশ জ্বলে যায়
দুর্ভিক্ষের আগুনে / এখনো লোকে জাগিলো না কেনে।’ কবির দেশাত্মবোধ ছিলো সুগভীর, ‘বাঙলার
জন্য জীবন গেলে হবো স্বর্গবাসী / আমার বাঙলার দাবী ঠিক থাকিবে যদিও হয় ফাঁসি।’
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম
থেকে বাংলাদেশের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত কবিয়াল রমেশ শীল সক্রিয় ভাবে অংশ
নেন। তাঁর গণসঙ্গীত দেশের মানুষদের এইসব সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ১৯৫৪ সালে
জনগণের ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং নূরুল আমিনকে পূর্ববাঙলার
গভর্নর বানানো হয়। এই নূরুল আমীন চট্টগ্রামে এলে জনগণের কাছে লাঞ্চিত হন। এই ঘটনা
নিয়ে রমেশ শীল বিখ্যাত একটি ব্যাঙ্গাত্মক গান রচনা করেন।
শোনো ভাই আজগুবি খবর,
মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন করে চট্টগ্রাম সফর।
দিনের তিনটা বেজে গেলো পল্টনে সভা বসিলো
হায় কি দেখিলাম কি ঘটিলো।
মানুষ ভয়ে জড়সড়
হঠাৎ দেখি পঁচা আণ্ডা
মন্ত্রীকে করিতেছে ঠাণ্ডা।
উড়তে লাগলো কালো ঝাণ্ডা,
মন্ত্রীর চোখের উপর।
বিপ্লবী চট্টগ্রাম গেলা সূর্যসেনের প্রধান কেল্লা
মন্ত্রী করে তৌব্বা তিল্লা,
করবো না জনমভরে চট্টগ্রাম সফর।
এই গানটি এতো জনপ্রিয়তা
পেয়েছিলো যে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এই জন্য তাঁকে কারাগারে নেওয়া হয়। সেখানে
তিনি এক বছর ছিলেন। এই সময় তাঁর বয়স হয়েছিলো সত্তর বছর এবং তাঁকে প্রচুর মানসিক
নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিলো। সেই সময় তাঁকে অঢেল বিত্তবৈভবের লোভ দেখিয়ে পাকিস্তানের
জাতীয় সঙ্গীত লেখার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখান করেন।
এই প্রলোভনের জবাব দিয়েছিলেন তিনি নিচের কবিতা দিয়ে।
আমার খুনে যারা করেছে
মিনার
রক্তমাংস খেয়ে করেছে কঙ্কালসার
আজ সেই সময় নাই ত্বরা ছুটে আসো ভাই
বেদনা প্রতিকারের সময় এসেছে।
রমেশ শীল রচিত বইয়ের সংখ্যা সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য পাওয়া যায় না, যেই সকল গ্রন্থের নাম পাওয়া যায় তার মধ্যে—‘আশেকমালা’, ‘শান্তিভাণ্ডার’, ‘নূরে দুনিয়া’, ‘দেশের গান’, ‘ভোট রহস্য’, ‘চট্টলা পরিচয়’, ‘ভাণ্ডারে মওলা’, ‘জীবন সাথী’, ‘মুক্তির দরবার’, ‘মানববন্ধু’, ‘চাটগাঁয়ের পল্লীগীতি—১ম ও ২য় ভাগ’; ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও তাঁর লেখা বইয়ের তালিকার বাইরে আরো ৮টি বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন—‘দেশ দরদী গানের বই’, ‘লোক কল্যাণ’, ‘১৩৬৭ সনের তুফানের কবিতা’, ‘এসেক সিরাজিয়া’, ‘মহাকাব্য বহি’, ‘১৯৬৩ সালের তুফানের কবিতা’, এবং ‘শান্তির কবিতা’। এছাড়াও রমেশ শীল বেদুঈন ছদ্দনামে ‘বদলতি জমানা’ শীর্ষক এবং ঋষিভট্ট ছদ্মনামে ‘ভন্ড সাধুর কবিতা’ শীর্ষক দু’টি বই প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর অন্যান্য প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে, নিকুঞ্জ বিহারী চৌধুরী সহযোগে ‘গান্ধী হত্যার কবিতা’। এইসব বইয়ের বাইরেও রমেশ শীলের প্রায় দেড়শ’য়ের বেশি কবিতা রয়েছে।
১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল বাঙলার
মহান লোকসাধক, দেশপ্রেমিক কবিয়াল রমেশ শীল অন্য আলোর পথে যাত্রা শুরু করেন; মৃত্যুর
এত বছর পরেও বাঙলার এই লোকসাধক কবিয়াল রমেশ শীল সমানভাবে জনপ্রিয়।